ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কৌশলগত জবাব

 


ইমরান হোসেন হিমু, সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট:

বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে চলছে নানান আলোচনা, তা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে, ভারতের সাথে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এবং বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান নৈতিক দূরত্ব একটি নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। ভবিষ্যতে যে দল বা জোট সরকার গঠন করবে, তাদের জন্য ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরোধিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হিসেবে দাঁড়াবে। এই প্রেক্ষাপটে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ভারতের বিপক্ষে একটি শক্তিশালী বৈশ্বিক অবস্থান তৈরি করতে হবে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় কার্যকরী হতে পারে।


ভারতের বিকল্প বাজার: আসিয়ান সদস্যপদের সম্ভাবনা

আজকের দিনে, ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ একটি বিকল্প বাজার এবং কৌশলগত অংশীদারিত্ব খুঁজছে। আসিয়ান (ASEAN) এর সদস্যপদ অর্জন করা বাংলাদেশের জন্য সেই বিকল্প হতে পারে। আসিয়ানের মতো শক্তিশালী একটি আঞ্চলিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করলে, বাংলাদেশ তার বৈশ্বিক অবস্থান সুসংহত করতে পারবে এবং একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।


বাংলাদেশের অর্থনীতি বিগত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল প্রায় $৪০০ বিলিয়ন ডলার। দেশের অর্থনীতি মূলত তৈরি পোশাক শিল্পের উপর নির্ভরশীল, যা বর্তমানে বৈদেশিক আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশেরও বেশি জোগান দেয়। এছাড়া কৃষি খাতও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিগত কয়েক বছরে রপ্তানি বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ দেশের অর্থনীতিকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছে। তবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও ভঙ্গুর। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে হ্রাস করতে পারে। এর ফলে, বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর বিদেশি বাজার ও অংশীদারিত্বের প্রভাব অনেক বেশি।


অন্যদিকে, ভারতের অর্থনীতি অনেক বড়। ২০২৩ সালে ভারতের জিডিপি প্রায় $৩.৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা তাকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি বানিয়েছে। ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রধানত প্রযুক্তি, পরিষেবা খাত, এবং ভারী শিল্পের উপর নির্ভরশীল। ভারতের তৈরি পোশাক, তথ্যপ্রযুক্তি, এবং ফার্মাসিউটিক্যাল খাত বিশ্ববাজারে বিশাল প্রভাব বিস্তার করে। তবে, ভারতের বিশাল জনসংখ্যার কারণে মাথাপিছু আয় তুলনামূলকভাবে কম।


আসিয়ান: একটি বিকল্প কৌশলগত বলয়

আসিয়ান (ASEAN), যা ১০টি সদস্য দেশ নিয়ে গঠিত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক সংস্থা। এর মোট জিডিপি ২০২৩ সালে ছিল প্রায় $৩.৩ ট্রিলিয়ন ডলার, যা এই সংস্থাকে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম অর্থনৈতিক ব্লক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আসিয়ানের সদস্য দেশগুলোতে প্রায় ৬৫০ মিলিয়ন মানুষ বাস করে, যা এই সংস্থাকে একটি বিশাল বাজারে পরিণত করেছে।

আসিয়ানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রধানত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (FTA) মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। এই চুক্তির আওতায়, সদস্য দেশগুলো শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পায়, যা বাণিজ্য সম্প্রসারণের মাধ্যমে তাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে। এছাড়া, আসিয়ান সদস্য দেশগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বিনিয়োগ বান্ধব নীতিমালা গৃহীত হয়েছে, যা বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক।


ভারতের সঙ্গে আসিয়ানের অর্থনৈতিক তুলনা

ভারতের জিডিপি আসিয়ানের সম্মিলিত জিডিপির তুলনায় বড় হলেও, আসিয়ান একটি বহুমুখী অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে কাজ করে। ভারতের অর্থনীতি প্রধানত অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং রপ্তানির উপর নির্ভরশীল, যেখানে আসিয়ান সদস্য দেশগুলো তাদের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে একটি সংহত অর্থনৈতিক ব্লক হিসেবে কাজ করে। আসিয়ান অঞ্চলের প্রধান খাতগুলোর মধ্যে কৃষি, তৈরি পোশাক, ইলেকট্রনিক্স, এবং প্রযুক্তি খাত উল্লেখযোগ্য।

ভারতের বাণিজ্য নীতিমালা অনেক ক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক, যেখানে আসিয়ান মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে বাণিজ্য সম্প্রসারণে উদ্বুদ্ধ। এ কারণে, আসিয়ান সদস্য দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে একটি সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরিচালনা করতে সক্ষম হয়।


বাংলাদেশের সম্ভাবনা: ডক্টর ইউনুসের নেতৃত্বে আসিয়ান সদস্যপদ

বাংলাদেশ যদি আসিয়ান সদস্যপদ লাভ করতে পারে, তবে এটি শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, কৌশলগত দিক থেকেও ভারতের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। আসিয়ান সদস্যপদ লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার তৈরি পোশাক শিল্প, কৃষি খাত, এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করতে পারে।

ডক্টর ইউনুসের নেতৃত্ব এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি ইউনুসের আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং কূটনৈতিক দক্ষতা তাকে এই প্রচেষ্টায় সফল হতে সাহায্য করতে পারে। তার নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হওয়ার কারণে বিশ্বজুড়ে তার একটি পরিচিতি এবং গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, যা বাংলাদেশের আসিয়ান সদস্যপদ অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বড় সুবিধা হতে পারে।


আসিয়ান সদস্যপদ লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারতের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী কৌশলগত জবাব দিতে পারে। আসিয়ানের শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্লকের অংশ হয়ে বাংলাদেশ তার বৈশ্বিক অবস্থানকে সুসংহত করতে পারবে। ভারতের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পেয়ে আসিয়ান অঞ্চলের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক তৈরি হবে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি আরও মজবুত করবে।

এই প্রক্রিয়ায়, ভারতের প্রভাব কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ। আসিয়ান সদস্যপদ অর্জন করে বাংলাদেশ একটি নতুন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক বলয়ে প্রবেশ করবে, যেখানে ভারতের প্রভাব সীমিত হবে। এর ফলে, ভারতের দীর্ঘদিনের আধিপত্যবাদী নীতি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নতুন ভারসাম্য তৈরি হবে।


বাংলাদেশ যদি আসিয়ানের সদস্যপদ লাভ করতে পারে, তবে এটি ভারতের বিরুদ্ধে একটি কৌশলগত জবাব হতে পারে। ডক্টর ইউনুসের নেতৃত্বে এই প্রক্রিয়া আরও সহজ এবং সফল হতে পারে। তার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা এবং দক্ষতা বাংলাদেশকে বৈশ্বিক অঙ্গনে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাবে। এই কৌশলগত পদক্ষেপ ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।